সারাদেশ ভিক্ষুকমুক্ত করার লক্ষ্যে এ পেশায় যুক্তদের পুনর্বাসনে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটছে না, বরং উল্টোটাই দৃশ্যমান। সম্প্রতি ঢাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। রাজধানীর বাড়িতে বাড়িতে, রেলস্টেশনে, লঞ্চ ও বাস টার্মিনালে, বিমানবন্দরে, হাসপাতালে, স্কুল-কলেজের সামনে, মসজিদে-মাজারে, জনাকীর্ণ স্থানে, সড়কে-অলিগলিতে, কাঁচাবাজারে, রেস্টুরেন্টের সামনে, বিপণিবিতানে, ট্রাফিক সিগন্যালে, এটিএম বুথের সামনে- যত্রতত্র এখন শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায়’ও ভিক্ষাবৃত্তি চলছে দেদার। বিশেষ করে করোনার পর ভিক্ষুকের সংখ্যা যারপরনাই বেড়ে গেছে। নিম্নবিত্ত মানুষ, যারা আগে অন্য কাজে যুক্ত ছিলেন বা শ্রম বিক্রি করতেন, তাদের অনেকেই নিরুপায় হয়ে এখন ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন।
সালেহা বেগম (৫০) দুই সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর ইসলামবাগে। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করতেন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের পর এটিও বন্ধ হয়ে যায়। সালেহা নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন। করোনার পর সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও তিনি ফেরেননি পুরনো পেশায়। ভিক্ষাবৃত্তিকেই অবলম্বন করে চলছে তার জীবন।
এমন অনেক সালেহা অন্য পেশা ছেড়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। মহানগরীর জনাকীর্ণ স্থানগুলোয় এক ঘণ্টা কাটালে পাঁচ/সাতজন ভিক্ষুকের মুখোমুখি হতে হয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা ভাইরাসের সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়েছে দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ধগতি। ‘দিন আনি দিন খাই’ শ্রেণির মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। পেটের দায়ে পথে নেমেছেন তারা, হাত পাতছেন জনে জনে, দুয়ারে দুয়ারে। ভিক্ষুকদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেড়ে গেছে উদ্বেগজনক হারে।
কারওয়ানবাজারে বাবার চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলেন হালিমা। ভিক্ষা করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাবা অসুস্থ। মা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। চিকিৎসার ব্যয় বহনের ক্ষমতা নেই তাদের। তাই বাবার চিকিৎসার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছেন।
এ ছাড়া ঢাকায় রয়েছে মৌসুমি ভিক্ষুক। তারা সবসময় ভিক্ষা না করে সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন ভিক্ষা করেন। আজিমপুর কবরস্থানের সামনে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে জড়ো হন প্রায় অর্ধশত ভিক্ষুক। যাদের একটা বড় অংশই ভিক্ষা করেন সপ্তাহে একদিন। এ ছাড়াও অনেকেই আছেন, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কাজ না করে বিভিন্ন অজুহাতে ভিক্ষাকেই অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। শাহানাজ নামের একজন ভিক্ষুক বলেন, আমি তো ভাঙাড়ি দোকানে কাজ করি। শুক্রবার আহি ভিক্ষা করতে। এক-দুই ঘণ্টা ভিক্ষা করি। বাড়তি কিছু টাকা আয় হয়। আমারে ভিক্ষুক কওন যায় না। যারা হারাদিন ভিক্ষা করে, হ্যারাই ভিক্ষুক। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে গিয়ে দেখা যায়, এ রকম অনেকেই নাছোড়বান্দা হয়ে ভিক্ষা চাইছেন মুসল্লিদের কাছে। এতে মুসল্লিরা বিরক্ত হলেও তারা অনেকটা অসহায়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ২০১০ সালে পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয় সরকার। লক্ষ্য- ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৩ সালে রাজধানীর বিমানবন্দর, সোনারগাঁওসহ গুরুত্বপূর্ণ সাতটি এলাকা চিহ্নিত করে এগুলোকে ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসব এলাকা থেকে অনেক ভিক্ষুককে তার নিজ এলাকায় ফেরত পাঠানো হয় পুনর্বাসনের জন্য। তাদের দোকান বা ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য আর্থিক সহায়তা, রিকশা-ভ্যান কিনে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা হয়। কর্মসূচির শুরু থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ৭৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে সরকার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ৩,০৫০ ভিক্ষুককে পুনর্বাসনে বরাদ্দ রয়েছে ১২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ২৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৭ জেলায় তিন হাজার জন এবং ২০২২-২১ অর্থবছরে পাঁচ কোটি টাকায় দুই হাজার ৮৫০ জনকে পুনর্বাসন করা হয়।
ঢাকা থেকে আটক করা ভিক্ষুকদের জন্য পাঁচটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে ১৬টি টিনশেড ডরমেটরি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে (’২১ সালের জুলাই থেকে ’২২ সালের জুন পর্যন্ত) উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটিতে ১৩০টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দুই হাজার ৬০০ ভিক্ষুককে আটক করা হয়। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এক হাজার ৮০৫ জনকে ভিক্ষাবৃত্তি না করার শর্তে মুক্তি এবং ৭৯৫ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। বর্তমানে ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধলা, গাজীপুর পূবাইল ও কাশিমপুর, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, মানিকগঞ্জের বেতিলা ও ঢাকার মিরপুরে ভিক্ষুক ও ভবঘুরেদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।
কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই বেশিরভাগ সুবিধাভোগী আগের পেশায় ফিরে আসেন। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অনেককে আটক করলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর ফলে সরকারের নেওয়া এ প্রকল্পটির সুফল নিয়ে সংসদেও প্রশ্ন উঠেছে। পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরুর পর ১৩ বছরে ঢাকার চেহারা দূরে থাক, সরকারের ‘ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত’ সাত এলাকার চিত্র একটুও বদলায়নি। সরকারিভাবে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করার পরও এসব এলাকায় সবসময় ভিক্ষুকদের ভিড় লেগে থাকে। গত কয়েকদিন সরেজমিন বেশিরভাগ স্পটে ভিক্ষুকদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
রাজধানীসহ সারাদেশে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে কাজ করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর। সংস্থা দুটির কাছে সারাদেশে থাকা ভিক্ষুকের সংখ্যার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারি হিসাবে দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা আড়াই লাখ বলা হলেও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মতে, এ সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি হতে পারে বলে তথ্যে জানা যায়। এর মধ্যে অসহায় ও পেশাদার ভিক্ষুকের সংখ্যারও সঠিক হিসাব নেই। শুধু রাজধানীতে ৫০ হাজারের বেশি পেশাদার ভিক্ষুক রয়েছেন বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। পেশাদার ভিক্ষুকদের রয়েছে বড় সিন্ডিকেট। তারা রাজধানীতে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপ-পরিচালক (ভিক্ষুক) মো. শাহজাহান গনমাধ্যমকে বলেন, এখন ঢাকায় ঠিক কতজন ভিক্ষুক আছে, আমাদের কাছে তার হিসাব নেই। সাম্প্রতিককালে কোনো গণনা হয়নি। আগে থেকে ভিক্ষুক বৃদ্ধি পেয়েছে বটে; কিন্তু কী কারণে সেটা জানি না। প্রতিবছর ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে সরকারের একটা বাজেট বরাদ্দ থাকে। বরাদ্দকৃত অর্থ উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বণ্টন করা হয়। ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের রিকশা-ভ্যান কিনে দেওয়া, দোকান করে দেওয়াসহ তারা যাতে কাজ করেন, সে ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অনেকে আবার ভিক্ষা পেশায় ফিরে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজ গবেষক অধ্যাপক ড. মো. রবিউর ইসলাম বলেন, বর্তমানে ঢাকায় ভিক্ষুক বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো করোনা মহামারী, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুই ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি রয়েছে। একটা হলো মানুষ বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছেন, আরেকটা হলো পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি। যারা পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি করছেন, তাদের পুনর্বাসন করা সম্ভব নয়। কারণ তারা পুরর্বাসনকেন্দ্র থেকে কিছুদিন পরই পালিয়ে যায়। আর অভাবে পরে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন যারা, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না করে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আমরা যদি তাদের কাজের ব্যবস্থা করতে পারতাম, তা হলে ভিক্ষাবৃত্তি কমে যেত। কিন্তু কাউকে ধরে নিয়ে যদি বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়, তা হলে বেশিদিন থাকবে না। পুনর্বাসন ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের ভুল রয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি জীবিকা নির্বাহের সহজতর উপায় হওয়ার কারণেও নিম্নবিত্তদের কেউ কেউ এ বৃত্তিতে আসছেন।