সাতক্ষীরার তালায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় পিতার ভূয়া সনদ দাখিল করে দু’সহোদরের সরকারি চাকুরী গ্রহনের তথ্যবহুল সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটিও বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে কথিত মুক্তিযোদ্ধা ললিতের তঞ্চকতাপূর্ণ সার্টিফিকেট নিয়ে গোমর ফাঁস হওয়ায় অনলাইন আবেদন ঠিক রেখে নতুন করে সার্টিফিকেট প্রস্তুত করতে পরিবারের পক্ষে বিভিন্ন মহলে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছে। ললিতের এক পৌত্র সরকারি কর্মচারী ও তালার আরেক মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আরেক সরকারি কর্মচারীর মধ্যে জাল সার্টিফিকেট প্রস্তুত করতে দরকষাকষির একটি মোবাইল কথোপকথনের অডিও বার্তা, ব্যাংক লেনদেনের তথ্যসহ নানা কর্মকান্ডে উঠে এসেছে জাল সার্টিফিকেট প্রস্তুতকারী সিন্ডিকেটের চমকপ্রদ তথ্য। ধারণা করা হচ্ছে, চক্রটির সাথে আরোও অনেকে জড়িত রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তে উঠে আসবে সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানা-অজানা চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের মৃত বসন্ত সাহার ছেলে মৃত লোলিত মোহন সাহা জীবদ্দশায় নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে একাধিক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রস্তুত করেন। যার একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাময়িক সনদপত্র, যার স্মারক নং-মুবিম/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯-০৪-২০০৩। যার সার্টিফিকেট নং-১৪৮৬০। সাময়িক সনদপত্র গ্রহনের পর ২০০৯ সালের ১৫ মে যুদ্ধকালীণ খুলানা বিভাগের লে: অবসরপ্রাপ্ত গাজী রহমতুল্লাহ দাদুর কাছ থেকে প্রত্যায়নপত্র গ্রহন করেন। ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ললিত মোহন সাহা। এরপর তার মৃত্যুর ৫ বছর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশরক্ষা বিভাগের স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র। একই বছরের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা সংসদের কমান্ডার মফিজ উদ্দিনের নিকট থেকে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়ন পত্র, দু’দিন পর ৬ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোশারফ হোসেন (মশু), একই বছরের ১৫ জুলাই ধানদিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও দক্ষিণ শারসা গ্রামের মৃত ফকির আহাম্মেদ গাজীর ছেলে মো: তবিবর রহমানের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়নপত্র গ্রহন করেন।
তবে এর মধ্যে মো: তবিবর রহমান প্রত্যায়ন দেওয়ার পর জানতে পারেন যে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। মূলত লোলিত মোহন সাহার ছেলেরা তাকে বিভিন্ন জাল ও তঞ্চকতাপূর্ণ সনদসহ ভূয়া প্রত্যায়নপত্র দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রত্যায়নপত্রটি গ্রহন করেছেন। মূলত এসব সনদে তার দু’ ছেলে যথাক্রমে বীরেন্দ্র নাথ সাহা ২০০৮ সালে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত হয়, অপরজন প্রতাপ কুমার সাহা ২০০৯ সালে একই কোটায় সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
এরপর তবিবুর রহমান ললিতের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ও তার দেওয়া প্রত্যায়নপত্রটি নিয়ে সাতক্ষীরা বিজ্ঞ ০৬ নং আমলী আদালতে প্রতাপ কুমার সাহা ও তার ভাই বীরেন্দ্র নাথ সাহার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। যার নং সিআর-১৯৬/২০(পাট), ধারা: ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪১৭ ও ১১৪ দ:বি:।
আদালত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআই সাতক্ষীরাকে নির্দেশ প্রদান করেন। সাতক্ষীরার এসআই সৈয়দ রবিউল আলম পলাশ দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গত ২০/৪/২১ তারিখে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে ১নং বিবাদী প্রতাপ কুমার সাহা ও ২ নং বিবাদী বীরেন্দ্র নাথ সাহা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় দাখিলকৃত তাদের পিতা ললিত মোহন সাহার নামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের স্মারক নং-মুবিস/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯/০৪/২০০৩ মূলে ১৪৮৬০ নং ক্রমিকের সাময়িক সনদপত্রটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় হতে যাচাই করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপ সাচব (সনদ) ডা: দুলাল কৃষ্ণ রায় স্বাক্ষরিত স্মারক নং ৪৮.০০.০০০০.০০৩.৫০.০৩০.১৮.৬১ তারিখ-২৩/০২/২০২১ এর মাধ্যমে জানানো হয় সাময়িক সনদপত্রটি সঠিক নয়। এছাড়া তারা জাল সনদকে আসল সনদ হিসেবে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অদ্যবধি সরকারি তহবিলের অর্থ গ্রহন করায় তাদের বিরুদ্ধে দি পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪২০ ধারার অপরাধ পাওয়া যায় বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে।
এদিকে আদালতের ১৯৬/২০ মামলায় নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে আসামী প্রতাপ কুমার সাহা ও তার ভাই বীরেন্দ্র নাথ সাহা গত ১৩/৪/২০২১ তারিখে সাতক্ষীরা বিজ্ঞ নোটারী পাবলিকের কার্যালয় থেকে এফিডেভিটের মাধ্যমে একটি অঙ্গীকার নামা প্রস্তুত করেন। যেখানে তারা বাদীর কাছ থেকে নেয়া প্রত্যায়নপত্র বাদীর অনুকূলে ফেরৎ প্রদানপূর্বক উল্লেখ করেন যে, ইতোপূর্বে তারা কোথাও প্রত্যায়নটি ব্যাবহার করেননি এমনকি ভবিষ্যতেও করবেননা। এছাড়া ঐ অঙ্গীকার নামায় তারা আরো উল্লেখ করেন যে, উক্ত প্রত্যায়ন ব্যাতীত মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র, সনদ তারা গ্রহন করেননি।
এর আগে পিতা ললিত মোহন সাহার মৃত্যুর ৩ বছর পর তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করতে তার বড় ছেলে জোগেশ চন্দ্র সাহা গত ২৮/১০/২০১৩ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে অনলাইনে আবেদন করেন। যার প্রেক্ষিতে মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি গত ১/১০/২০১৫ তারিখে তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিকে প্রেরণ করেন।
এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমান চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারী মৃত ললিত মোহন সাহাকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই তালিকা থেকে বাদ দিতে ও তালিকায় অন্তর্ভুক্তি না করতে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তালাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক পৃথক আবেদন করেন। যেখানে তিনি ললিত মোহনের পক্ষে ছেলের গেজেটভূক্ত করতে অনলাইন আবেদনের অনুকুলে যাচাই বাছাই কমিটিতে স্বাক্ষীসহ উত্থাপিত তথ্যাদি জাল-জালিয়াতির মাধ্