‘মোগল মুমেন্টস অব বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থ দ্বারা প্রকাশিত হয় মৌলভী কাজী সালামতউল্লাহ খান বাহাদুর তেঁতুলিয়ার একজন জমিদার ছিলেন। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলের ডেপুটি কালেকটর এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। জমিদার কাজী সালামতউল্লাহ আঠারো শতকের দিকে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
তথ্যমতে, মসজিদটির সঙ্গে ১৮৪০-৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার শাহজানী বেগম মসজিদ এবং ১৮৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। মসজিদটির নকশা ও কারুকাজের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিহারের এক বাসিন্দা। তবে নির্দিষ্ট সাল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। ১৮১৮, ১৮২৫ কিংবা ১৮৫৮-৫৯ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। মসজিদের খুব কাছে ‘সালাম মঞ্জিল’টিও সমসাময়িক কালে কাজী সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদটি খুলনা-পাইকগাছা সড়কের কোল ঘেঁষে তালা উপজেলা সদরের দুই-তিন কিলোমিটার উত্তরে আঠারো মাইল অভিমুখে আঞ্চলিক সড়কের পাশে এক একর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। মসজিদের সঙ্গেই প্রায় দুই একর আয়তনের একটি বিশাল পুকুর রয়েছে। মসজিদটিতে রয়েছে ৭টি দরজা। প্রতিটি দরজার উচ্চতা ৯ ফুট এবং প্রস্থ ৪ ফুট। ১০ বর্গফুট বেড়বিশিষ্ট ১২টি পিলারের ওপর মসজিদের ছাদ নির্মিত। চুনসুরকি ও চিটাগুড়ের গাঁথুনিতে নির্মিত মসজিদটিতে ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ৬টি বড় গম্বুজ এবং ৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ১৪টি মিনার রয়েছে। এছাড়া ২৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট চার কোণে ৪টি মিনার রয়েছে। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর তাদের আয়ত্তে নিয়ে এরশাদ সরকারের সময় সর্ব সংস্কারের আলোর মুখ দেখে এই মসজিদটি। তার পর থেকে অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে মসজিদটি।
প্রাচীন এই মসজিদটি সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হলেও সঠিক তদারকির অভাবে সৌন্দর্য হারিয়েছে মসজিদটি। বর্তমানে ভবনটির রং চটে গেলেও সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেই। বিভিন্ন মিনারের কোণ থেকে বালু ধ্বসে পড়ছে। ভবটির মুল অবকাঠামোতেও বড় বড় ফাটল ধরেছে। মসজিদ সংলগ্ন দিঘিটিও সৌন্দর্য হারিয়েছে।
সূত্র মতে, মসজিদটিতে একজন খতিব, একজন ওয়াক্তি ইমাম, একজন মুয়াজিন, একজন খাদেম রয়েছে। সীমিত সম্মানী দেয়া হয় তাদেরকে।
মুসল্লিরা জানান, মসজিদের পরিচালনা কমিটি থাকলেও মসজিদের সংস্কার ও অন্য কাজ কার কমিটির এখতিয়ার নেই। জুম্মার দিনে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিরা মসজিদে জায়গা না পেয়ে সড়কে বসেই নামাজ আদায় করে। ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের নামে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গাফিলতিতে মসজিদটিতে নামাজ বন্ধের উপক্রম। একটু বৃষ্টি এলেই মসজিদের ভেতরে পানি পড়ে। নেই টয়লেট। ভেঙে পড়ছে মসজিদটির ছাদ ও দেয়াল।
স্থানীয়দের দাবী, প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ ও সংস্কারের নামে সরকার প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণে বরাদ্দ দেয় তা যায় কোথায়। শুধু তালা তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদের নামে বিগত ১০ বছরে সরকারের বরাদ্দের ১০ লক্ষ টাকারও কোন হদিস নেই। সংস্কার করতে না দেওয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে মসজিদটি।
স্থানীয় মুসাল্লি মোঃ নুর ইসলাম বলেন, মসজিদটি কত সালে নির্মিত হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে বর্তমানে অযত্ন আর অবহেলায় ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটির সৌন্দর্য নষ্ট হতে বসেছে। ৭টি মিনার ভেঙে পড়ার উপক্রম। মসজিদের বাউন্ডারি এলাকায় বহু অজানা ব্যক্তির কবরের চিহ্ন থাকলেও সেগুলো অরক্ষিত। মসজিদটির ফ্লোরে ও পশ্চিম পাশের দেয়ালের উপরের অংশে ফাটল ধরেছে। সরকারিভাবে মসজিদটি পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে মুসল্লিদের দান খয়রাতের উপর চলছে ইমাম মুয়াজিনের বেতন দেয়ার কাজ।
তিনি আরও জানান, মসজিদটির সামনে একটি দিঘী রয়েছে। এই দিঘী থেকে কখনও পানি শুকাতো না। কিন্তু এখন পানি শুকিয়ে যায়। এই মসজিদটিতে গভীর রাতে জিনদের পদচারণা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
৩০ বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্বে থাকা মসজিদটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মারুফ হোসেন তুরান জানান, ১৯৮৭ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মসজিদ কমিটি মসজিদের কোন সংস্কার কাজ করতে পারে না। ঐতিহ্য নষ্ট হবে এমন অভিযোগ তুলে উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। একজন তত্ত্বধায়ক দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় না। মসজিদের খরচ বহন করার কথা থাকলেও তা করা হয়না।
দীর্ঘ ৫০ বছর মুয়াজিনের দায়িত্বে থাকা কাজী মাসুদ জানান, মসজিদটি বহু পুরনো। সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েনি। মসজিদের গুম্বুজের কয়েকটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় মুসল্লিরা মসজিদের ভেতরে নামাজ আদায় করেন। গত ২৬ বছরে কোনও সংস্কার হয়নি। জুম্মার দিনে মসজিদে মুসাল্লি বৃদ্ধি পাওয়ায় সামনের দিকে টিনের শেড নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেও বাধাঁ প্রদান করেছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। ২শত বছরের পুরোনো এই মসজিদটি এভাবে চলতে থাকলে কালের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাবলী ইয়াসমিন জানান, আমরা সম্প্রতি মসজিদটি পরিদর্শন করেছি। ইতোপূর্বে মসজিদের সংস্কার সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ বছর বাজেটের কাজ সব শেষের পথে,সামনে যে বাজেট হবে আগামী দিনগুলোতে এর প্রয়োজনীয় সংস্কার সংরক্ষণ কাজের পরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম করা হবে।